যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন জো বাইডেন। ২০ জানুয়ারি তার শপথ; এর মাধ্যমে সমাপ্তি হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জামানার।
পুরো শাসনামলে ট্রাম্পের নেয়া বিদেশনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চিরায়ত জোটসঙ্গীদের হতাশ করেছে, বন্ধুদের ক্ষুব্ধ করেছে এবং কখনো কখনো শত্রুদের সুবিধা করে দিয়েছে।
বাইডেনের বিদেশনীতি অনেকটাই আলাদা হবে।
কিন্তু সেটা তার জন্য যেমন সহজ হবে না তেমনি এজন্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চরম মূল্যও দিতে হবে। কারণ, ঘরের মধ্যেই চরম বিভক্ত মার্কিনীরা।
নিজের ফরেন পলিসির টিমও সাজিয়ে ফেলেছেন বাইডেন। অপেক্ষা কেবল কংগ্রেসে অনুমোদনের।
মিডল ইস্ট এবং উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে যে কাজগুলো করবেন না বাইডেন।
মরক্কো থেকে শুরু, পূর্বদিকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল। এখানে বাইডেনকে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে হবে যার মধ্যে কোনোটিই আসলে সরল হবে না।
সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা অঞ্চল মরক্কোর বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অথচ আলজেরিয়া এবং তাদের মিত্র শাহরাবি আরব ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ওই অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে আসছে।
শাহরাবি আরব ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ওই অঞ্চলকে তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র বলে দাবি করে।
ওই অঞ্চল নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় কয়েক দশক ধরে মধ্যস্থতা করছিল জাতিসংঘ;
যা ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের কারণে মাঠে মারা পড়ে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এটি এখনো ‘বিতর্কিত’ অঞ্চল।
আসলে ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য তেমন কিছু বয়ে আনবে না; বরং ওই বিরোধে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারীর জায়গা হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বাইডেন ওই অবস্থান থেকে সরেও আসবেন না, সামনের দিকে আর আগাবেনও না।
ইসরাইলের সঙ্গে মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ ছাড়া ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের পেছনে আর কোনো কারণই ছিল না।
পরবর্তী হটস্পট লিবিয়া।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক ওবামা ২০১১ সালে দেশটি ধ্বংস করেছিলেন। বাইডেন তখন ছিলেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট। এরপর ট্রাম্প এসে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। বরং সেখানে বিবাদমান পক্ষগুলোর জন্য ট্রাম্পের কথাবার্তা ছিলো বিভ্রান্তিকর। ২০১৯ সালে দেশটির সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেনারেল খলিফা হাফতার দেশটির জাতিসংঘ স্বীকৃতি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেন তখন ট্রাম্প থাকে ফোন করলেন; ‘সন্ত্রাস’ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন।
এখানেও বাইনে শুধুই বলবেন, করবেন না তেমন কিছুই।
২০১১ সালে তার সাবেক বস বারাক ওবামা যখন দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেন তখনই তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। ওই সময় তিনি একটাই প্রশ্ন তুলেছিলেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন হলে লিবিয়ার কি হবে?
নিজেদের প্রশাসন থেকেও তিনি সেই প্রশ্নের উত্তর পাননি। আজও মেলেনি সেই প্রশ্নের উত্তর; ওই প্রশ্নের উত্তর তিনি এখন হয়তো খুঁজতেই যাবেন না।
লিবিয়ার দরজাতেই আরেক দেশ মিশর; যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মিত্র।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একবার দেশটির সামরিক শাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে তার ‘সবচেয়ে পছন্দের স্বৈরশাসক’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। অথচ তার বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তিনি কোনো পদক্ষেপই নেননি।
বাইডেন হয়তো এসব নিয়ে কিছু উচ্চবাচ্য করবেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করবেন না; এভাবেই চলতে দিবেন।
তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে সাবেক বস বারাক ওবামার মতো মিশরকে প্রতিবছর দেয়া ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারেন। কিন্তু তাতে মিশর তার অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার পলিসি পরিবর্তন করবে না।
এরপর আছে ইসরাইল।
নিজের ক্ষমতার পুরো সময়জুড়ে ফিলিস্তিনিদের পায়ে মাড়িয়েছেন ট্রাম্প। অপরদিকে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকার চেয়ে ইসরাইলের সরাসরি পক্ষই নিয়েছেন তিনি। বহু আরব রাষ্ট্র, এমনকি বহু দূরের দেশ সুদানকে পর্যন্ত ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাপ দিয়েছেন। জাতিসংঘের রেজ্যুলুশনের তোয়াক্কা না করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মার্কিন দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করেছেন।
বাইডেন এগুলোর কিছুই পরিবর্তন করবেন না; যেমন আছে তেমনই থাকবে।
তিনি যেটা করতে পারেন তা হল- ট্রাম্পের সময়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অতিরিক্ত যে ক্ষোভ জমেছে তা কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করবেন। এজন্য ওয়াশিংটনে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের ব্যুরো অফিস পুনরায় চালু করতে পারেন। এছাড়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ পরিচালিত সংস্থাগুলোতে মানবিক সাহায্য প্রদান আবার শুরু করতে পারেন।
কিন্তু এতে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনির ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না।
গাজায় ইসরাইল চলমান নির্মম অবরোধের উঠবে না; বরং দশকব্যাপী গাজা অবরোধ আরও শান্তিপূর্ণভাবে বহাল থাকবে।
এবার যাওয়া যাক সিরিয়ায়।
দেশটির পরিস্থিতি বদলে ফেলার মতো খুব বেশি কিছু যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই নেই।
বড়জোর দেশটির থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটার গতি কিছুটা কমতে পারেন বাইডেন।
উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় মার্কিনীদের ছোট সেনাবহর থেকে যাবে।
দায়েশকে প্রতিহতে অভিযান চলবে; গোলান মালভূমিতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্বও বহালই থাকবে।
আসলে বাইডেন সিরিয়া সংকটে তেমন কোন কঠোর সামরিক পদক্ষেপ নেবেন না। দায়েশের বিরুদ্ধে যদি কোন অভিযান চালাতে চানও সেটা হবে খুবই ছোট এবং খুবই বিলম্বিত। এখানে বরং তুরস্ক এবং রাশিয়ার মতো মূল খেলোয়াড়দের সঙ্গে বেশি অংশীদারিত্ব চাইবেন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ওপর অবরোধ বাড়ানো তার জন্য সহজ এবং সুবিধাজনক পদক্ষেপ হবে।
এসবের মধ্যেই দেশটিতে থেকে তেল চুরি অব্যাহত রাখবেন বাইডেন।
সৌদি আরব।
যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক এবং একনিষ্ঠ বন্ধু। বাইডেন মাঝে মধ্যেই সৌদির প্রতি রাগ-ক্ষোভ উগরে দেবেন। ‘নিষ্ঠুর’ যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের জন্য বাইডেন হবেন অস্বস্তিকর। সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার পর যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যুবরাজকে যেতে হয়েছে বাইডেনের পুরো সময়ই তেমন পরিস্থিতিতে তার থাকা লাগতে পারে।
কিন্তু সৌদির ‘তেল নিয়ে অস্ত্র বিক্রির’ যে ধারা সেটাকে তিনিও অবশ্যই বজায় রাখবেন; বলতে গেলে, সৌদির সঙ্গে তার প্রশাসনের সম্পর্কও এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই চলবে।
ইরানকে চাপে রাখার জন্য তারও দরকার দুর্নীতিবাজ অস্বচ্ছ সৌদি আরবকে।
ইসরাইলের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সৌদি আরবই আলোড়ন তুলছে। এছাড়া ইরানকে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তাকেও উপেক্ষা করতে পারবেন না বাইডেন।
ইরাক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সিরিয়াস একটি বৈদেশিক ইস্যু।
ইরাকিদের মধ্যে এবং দেশটির রাজনীতিতে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি বাইডেনও একইরকম রাখবেন। তবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের গতি কমিয়ে আনলেও তা চালু রাখবেন। ইরাকের মাটিতে মার্কিনীদের ঘুম হারাম করে তুলবে ইরান। আর এ বিষয়টিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বাইডেনের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির দরকষাকষিতে কাজে লাগাবে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই বাইডেন ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির দিকে নজর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
পুরো ইরাক এবং উপসাগরীয় জলসীমা মূলত ইরানের হাতের তালুর মতো। পূর্বসূরি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসতে চান বাইডেন। তবে বিষয়টি নিয়ে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত মিত্র সৌদি আরব এবং ইসরাইলের সঙ্গে সওদা করতে হবে তাকে।
ইরানের ওপর চাপানো নিষেধাজ্ঞাগুলো খুব দ্রুতই উঠে যাবে না; এজন্য ইরানকেও অনেক ছাড় দিতে হবে।
২০২২ সালের আগে আসলে তেমন কিছু আশা না করাই ভালো।
আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আফগানিস্তান পর্যন্ত ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পলিসি বাইডেনও অনুসরণ করবেন। তিনিও মার্কিন সেনাদের ঘরে ফেরানো অব্যাহত রাখবেন।
আফগানিস্তানে সেনা কমিয়ে দায়েশ এবং আল কায়েদার লক্ষ্যবস্তুগুলোতে দৃষ্টি বাড়াতে চাইবেন বাইডেন। ট্রাম্পের দেখানো পথ ধরে তালেবানের সঙ্গে প্রকাশ্য এবং গোপন যোগাযোগও অব্যাহত রাখবেন।
আর এভাবেই একটু একটু করে আফগানিস্তান মুঠোয় পুরে নেবে তালেবান।
মিডলইস্ট মনিটরে লিবিয়ান ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ড. মুস্তফা ফিতুউরির লেখা অবলম্বনে।
আরও পড়ুন:
শিয়া-সুন্নি: মুসলমানরা যেভাবে ভাগ হল
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ভয়াবহতা স্বীকার করলেন ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির জনক
বিধ্বংসী লেজার ক্ষেপণাস্ত্রের উদ্বোধন করল ইরান
চীনের হাত ধরে পুরনো বন্ধু ভারতকে দূরে ঠেলল ইরান
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, ইন্টারপোলে গেল ইরান