বিশ্বে যে কটা শান্তির দেশ আছে তার মধ্যে অন্যতম সেরা হলো নরওয়ে। নরওয়ের অপরাধ প্রবণতা একেবারে কম এবং এই দেশটি জীবন ধারনের জন্য নিরাপদ। মধ্যরাতে সূর্যের দেশখ্যাত নরওয়েতে কোন অপরাধের দেখা পাওয়া ভার! দীর্ঘায়ু, শারীরিক সুস্থতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সামাজিক সহায়তার জন্য জনগন শান্তির আধারে বাস করেন।
নরওয়ের নাম বললে মনে আসে নোবেল শান্তি পুরস্কারের কথাও। দেশটির রাজধানী অসলোতে রয়েছে ‘নোবেল পিস সেন্টার’৷ সেখানে শান্তিতে নোবেলজয়ীদের বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়। অসলোর গ্র্যান্ড হোটেলের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে দর্শকদের অভিনন্দন গ্রহণ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরা।
এই দেশটিতে আপনি যদি অভুক্ত হন এবং খাবার ক্রয়ের টাকা না থাকে তাহলে যে কোন খাবারের দোকানে গেলেই খাবার পাবেন। কেননা আপনার খাবারের দাম আগেই অন্য একজন মিটিয়ে গেছেন। অথচ আপনার সঙ্গে তার পরিচয় নেই। এই দৃশ্য অহরহ দেখতে পাবেন বিভিন্ন রেস্তোরায়।
যেমন ধরুন- রেস্তোরার এক ভদ্রমহিলা এসে ৫ টা কফি আর একটা সাসপেনশন অর্ডার দিলেন। উনি ক্যাশ কাউন্টারে পাঁচটি কফির বিল মেটালেন আর চার কাপ কফি নিয়ে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে, এক ভদ্রলোক এলেন আর অর্ডার করলেন, দুটো লাঞ্চ প্যাক করুন আর দুটো সাসপেনশন রাখুন। উনি চারটে লাঞ্চ এর বিল মেটালেন আর দুটো লাঞ্চ প্যাকেট নিয়ে চলে গেলেন।
তার কিছুক্ষণ পর আরো একজন এলেন। অর্ডার করলেন, দশটা কফি, ছটা সাসপেনশন। উনি দশটা কফির পেমেন্ট করলেন আর চারটে কফি নিয়ে গেলেন। এভাবেই একের পর এক চলতে লাগলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে, একটি বৃদ্ধ ব্যক্তি জর্জর অবস্থায় কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো সাসপেনশন কফি আছে? কাউন্টার থেকে জানানো হলো- অবশ্যই আছে এবং এক কাপ গরম কফি ওনাকে দেওয়া হলো।
তারও অল্প কিছুক্ষণ পরে এক দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ভিতরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ কি কোনো লাঞ্চ সাসপেনশনে রাখা আছে? কাউন্টার থেকে যথারীতি সম্মতি জানিয়ে, তাকে গরম খাবারের একটি পার্সেল আর এক বোতল জল দেওয়া হলো।
এই ব্যাপারটা সারাদিন চলছে, চলছে তো চলছেই। কিছু মানুষ নিজেদের পকেট থেকে, নিজেদের অর্জিত রোজগার থেকে, কিছু অজানা মানুষের খাওয়ার জন্যে পেমেন্ট করছেন। আর কিছু গরীব, দুস্থ মানুষ বিনা পেমেন্টে নিশ্চিন্তে খাওয়া দাওয়া করছেন। কেউ জানে না কারো পরিচয়। না দাতা জানে গৃহীতার পরিচয়, না গ্রহীতা জানে দাতার পরিচয়!
বছরের আট মাস বরফের নিচে ঢাকা থাকে নরওয়ে। আর বছরের দুই মাস এখানে সূর্য ওঠে না। নভেম্বরের ২১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ২১ তারিখ পর্যন্ত সময়টাকে দেশটির ডার্ক পিরিয়ড বলা হয়। এই সময় আকাশে নর্দার্ন লাইট বা অরোরা বুরিয়াল দেখা যায়। আকাশে লাল, সবুজ রঙের আলোর খেলা। এই অরোরা দেখতে অনেক পর্যটক এই সময়ে এখানে আসেন।
আর মে মাসের ২১ তারিখ থেকে জুলাইয়ের ২১ তারিখ পর্যন্ত সূর্য ওঠে না। এই সময়টাকে বলা হয় মিডনাইট সানের সময়। এই ঘটনাটিকে হোয়াইট নাইট বলেও উল্লেখ করা হয়। একটানা সূর্যের আলো বিদ্যমান থাকে এবং রাতের অন্ধকারের পরিবর্তে আকাশে গোধূলির আলো ফুটে থাকে। সত্যি অদ্ভুত।
সামারের সময় যদি আবহাওয়া ভালো থাকে তাহলে এখানকার প্রকৃতি এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ধারণ করে। চোখ ধাঁধান সুন্দর। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এই পরাবাস্তব দৃশ্য অবলোকন করতে নরওয়েতে আসে।
বিশ্বজুড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশটির পরিচিতি মূলত মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে থাকলেও এটি ছাড়াও এই দেশটির বিশেষত্ব হিসেবে রয়েছে এর বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। রুপকথার গল্পের মত সুন্দর সব সমুদ্রখাত, অরোরা বোরিয়ালিস বা উত্তরের আলো, তুষার ঢাকা বিস্তৃত মালভুমি আর অবিশ্বাস্য সুন্দর সব পর্বতমালা। আর এই কারনেই নরওয়ে মধ্যরাতের সূর্যের দেশ হিসেবে পরিচিত।
নরওয়ে পৃথিবীর ১১৯তম জনবহুল দেশ। ২০১৮ সালে জনসংখ্যা প্রায় ৫৩৫ মিলিয়ন, যার ৫০.৫০ শতাংশ পুরুষ। অভিবাসী জনগোষ্ঠীর আকার মাত্র ২১৩৪৯ জন। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা ১৬৫৩ জন। তবে ১৬৬৫ সালে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪ লাখ ৪০ হাজার।
নরওয়ের রাজধানি ‘অসলো’। অসলোকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর অন্যতম ব্যায়বহুল এবং সমৃদ্ধ শহর। নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং দেশের অন্যতম প্রধান সমুদ্র বন্দর বারগেন। নরওয়ে ইউরোপের দ্বিতীয় জনবহুল রাষ্ট্র। সবচেয়ে বেশি তেল ও গ্যাসের খনি রয়েছে দেশটিতে। নরওয়ে এর মুদ্রার নাম নরয়েজিয়ান ক্রোন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাবে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটি বিশ্বে চতুর্থ।
রাতে চলাচলে সবচেয়ে নিরাপদ ধরা হয় নরওয়েকে। চুরী, ছিনতাই এবং ডাকাতি হয় না। দেশটির ৮৬ শতাংশ মানুষ রাতের বেলা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে না। পুরো নরওয়েতে যে কোন সমস্যা হলে (১১২) কল করলেই সাথে সাথে পুলিশ চলে আসবে আপনাকে সাহায্য করার জন্য।
নরওয়ের অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আরেকটি উৎস হচ্ছে এর সমুদ্রখাড়ি গুলো যা ফিয়র্ড নামে পরিচিত। বরফ যুগের শেষে এর গভীর উপত্যকা এবং সংকীর্ণ খাড়ি গুলো সমুদ্রের পানিতে ডুবে যায় এবং মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি হয়। যদিও বিশ্ব জুড়ে এরকম অসংখ্য সমুদ্রখাড়ি রয়েছে, কিন্তু নরওয়ের সমুদ্রখাড়িগুলো পর্যটকদের নিকট অত্যাধিক জনপ্রিয় এগুলোর নজরকাড়া সৌন্দর্য্যের জন্য।
নরওয়েতে রয়েছে হাজার হাজার নয়নাভিরাম হ্রদ। মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি এ সকল হ্রদে পাওয়া যায় ইউরোপের সবচেয়ে সুস্বাদু স্যামন মাছ। নরওয়ে এই সুস্বাদু স্যামন বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে রপ্তানি করে থাকে। হ্রদের কিনার ধরে রয়েছে জেলেদের সারি সারি কেবিন। এছাড়াও ইউরোপের সবচেয়ে গভীর হ্রদ নরওয়েতে অবস্থিত।
নরওয়ের সৌন্দর্য্যের আধার বলা হয় উত্তর নরওয়েতে অবস্থিত লোফোটেন দ্বীপপুঞ্জকে। এখানে দৃষ্টিনন্দন বেলাভূমি থেকে শুরু করে আরও রয়েছে সুউচ্চ পর্বত শ্রেণি, রহস্যময় সমুদ্র খাড়ি, ছবির মত সুন্দর জেলেদের গ্রাম আর সবুজের সমারোহ।
উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ার পশ্চিম অংশে অবস্থিত নরওয়ে। সুইডেন সঙ্গে ১,৬১৯ কিলোমিটার, ফিনল্যান্ড সঙ্গে ৭২৭ কিলোমিটার এবং পূর্ব রাশিয়া সঙ্গে ১৯৬ কিলোমিটার সীমানা আছে নরওয়ের। দেশটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ব্যারেন্টস সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর, উত্তর সাগর, এবং ব্যারেন্টস অবস্থিত।