ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং ধর্মীয় অনুশীলনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিয়া-সুন্নি দুই পক্ষ একমত। দুই দলের বিভক্তিটা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৪শ’ বছর আগে যখন মহানবী (স.) এই পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলেন।
মহানবীর ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব কে দেবেন সেটা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়।
এই বিভক্তিই আজও শিয়া এবং সুন্নি নামে দুই উপদলে ভাগ করে রেখেছে মুসলিম বিশ্বকে।
সারাবিশ্বের ১.৬ বিলিয়ন মুসলিমের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। আর ১৫ শতাংশের মতো শিয়া।
ইরান, ইরাক, বাহরাইন এবং আজারবাইজানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এছাড়া লেবাননেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিয়া মুসলিমের বাস; এর বাইরে সৌদি আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ভারতে অনেক শিয়া মতাবলম্বী মুসলিম বাস করেন।
অপরদিকে মরক্কো থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ ৪০টি দেশে সুন্নিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ঘিরে ধর্মীয় বিভক্তি:
কিছু ভিন্নতার পরেও শিয়া এবং সুন্নিরা শতশত বছর ধরে একসঙ্গে সৌহার্দ বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। ইতিহাসে চোখ ফেরালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বিভেদ বাড়তে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শিয়া এবং সুন্নি কট্টরবাদীদের মধ্যে সহিংসতা বেড়ে যায়।
এর পেছনে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার- উভয়ই কাজ করছে।
শিয়া-সুন্নি বিভেদের মূলটা পোতা হয় সপ্তম শতাব্দীতে, মহানবীর (স.) ওফাতের পরপরই।
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ (স.) এর মৃত্যুর আগে ইসলামের কোন উপদল ছিলো না। কিন্তু তিনি মারা যাবার পর কে মুসলিম খেলাফতের শাসক হবেন তা নিয়ে উম্মাহর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তখন মোহাম্মদ (স.) এর বেশিরভাগ অনুসারীই চাইছিলেন, ইসলামিক কমিউনিটির অন্য অভিজাত সদস্যদের উচিৎ খলিফা নির্বাচন করা। অপর দিকে একটি ছোট গ্রুপ দাবি করে, মোহাম্মদ (স.) এর পরিবারের কাউকে অর্থাৎ তার চাচাত ভাই এবং জামাই আলি ইবনে আবু তালিবকে খলিফা হিসেবে দেখতে।
এই গ্রুপটাই পরবর্তী সময়ে ‘শিয়া আলি’ বা ‘আলির অনুসারী’ বলে পরিচিত হয়। পরবর্তীতে সহজে এই গ্রুপটিকে বলা হয় ‘শিয়া’।
মহানবীর (স.) এর উত্তরাধীকার:
মহানবী (স.) এর তিনটি পুত্র সন্তান (কাসেম, তাহের-অনেক ঐতিহাসিকের মতে, তাঁর নাম ছিল ‘আবদুল্লাহ’ এবং ইব্রাহিম) জন্ম নিলেও তারা সবাই অল্প বয়সেই মারা যায়।
‘আফটার দ্যা প্রফিট: দ্যা এপিক স্টোরি অব দ্যা শিয়া-সুন্নি স্প্লিট ইন ইসলাম’ বইয়ের লেখক লেসলি হ্যাজলেটুন বলেন, যেহেতু কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারী ছিলো না এবং তিনি কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনিত করে যাননি, তাই তাঁর ওফাতের পর অনুসারীদের মধ্যে নেতা নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়। এতে শেষ পর্যন্ত সুন্নি (সুন্নাহ বা প্রথা থেকে এই নাম) সংখ্যাগরিষ্ঠরাই বিজয়ী হন এবং মোহাম্মদ (স.) এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আলী বিন আবু তালিবকে খলিফা নির্বাচিত করেন।
আলি হন চতুর্থ খলিফা (শিয়ারা বলে থাকেন ইমাম)।
অর্থ আর ক্ষমতা
৬৬১ সালে হযরত আলী (রা.) হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপরেও শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। এর পেছনে শুধু মোহাম্মদ (স.) এর রেখে যাওয়া ইসলাম এবং তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বিষয়টিই কাজ করেনি। বরং ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদিও কাজ করেছে। ওই সময় ইসলামী খেলাফতের অধীনে থাকা বিভিন্ন গোত্রগুলো থেকে বড় অংকের ট্যাক্স, কর গ্রহণ করা হতো। এই অর্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক পর্যায়ে মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্য ইউরোপের স্পেন পর্যন্ত সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় মুসলিমরা।
মোহাম্মদ (স.) এর কোরাইশ গোত্রের দুইটি বিবদমান শাখা – হাশেমী এবং উমাইয়াদের মধ্যে শুরু থেকেই বংশগতভাবে ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিলো। হাশেমী এবং উমাইয়া গোত্রের এই বংশগত দ্বন্দ্বই শিয়া-সুন্নি বিরোধের মূল হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে বলা যায়। এই দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে মুসলিম জাতির আরো অসংখ্য বিরোধের জন্ম হয়েছে।
এটি ধীরে ধীরে আদর্শ সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে।
আর ধর্মীয় গুরুরা যখন এটিকে মাজহাবের দিকে নিয়ে ইবাদতের পদ্ধতিতে ভিন্নতা নিয়ে আসেন তখন তা আরও মারাত্মক রূপ নেয়।
মহানবী (স.) ছিলেন হাশেমী গোত্রের। এই হাশেমীরা আবার পরবর্তী সময়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাসূল (স.) এর চাচা আব্বাসের বংশের লোকেরা ও তাদের অনুসারীরা আব্বাসীয় হিসেবে পরিচিত হন; আর মহানবীর (স.) কন্যা ফাতেমার দুই ছেলে ইমাম হাসান-হোসেনের বংশধরেরা ও তাঁদের সমর্থকেরা ফাতেমীয় হিসেবে পরিচিত হন।
এই ফাতেমীয়রাই এখন শিয়াদের নেতৃত্বে রয়েছে বলা যায়।
কারবালার যুদ্ধ: শিয়াদের শেষ থেকে শুরু

কারবালায় ইমাম হুসেইনকে হত্যা করা হয়; প্রতীকী ছবি
৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে, আলীর পুত্র হুসেইন (রা.) মক্কা থেকে ৭২ জন অনুসারী নিয়ে কারবালার (বর্তমানের ইরাক) উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত খলিফা ইয়াজিদ এবং উমাইয়া রাজবংশের সঙ্গে মোকাবিলার জন্যই তিনি বেরিয়েছিলেন। এদিকে তাদের পথ রোধ করে খলিফার অনুসারী বিশাল এক সুন্নি বাহিনী। ১০ দিন ধরে ছোট-খাটো লড়াইয়ের পর শেষ পর্যন্ত হুসেইনকে (রা.) হত্যা এবং শিরোশ্ছেদ করা হয়।
শুধু তাই নয়, সুন্নি খলিফা ইয়াজিদকে খুশি করতে সেই কাটা মাথা দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়।
লেসলি হ্যাজলেটুন বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে উমাইয়ারা এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলো যে, সরাসরি মোহাম্মদ (স.) এর রক্তসম্পর্কীয় কেউ যাতে খলিফার আসনে বসার মতো না থাকে। কারবালায় হুসেইন (রা.) এবং তার পরিবারের সবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উমাইয়াদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়। শিয়ারা যে দাবি করে আসছিলো সেটা বাস্তবায়নের জন্য আর কোনো নেতা অবশিষ্ট থাকলো না; ফলে তাদের আন্দোলন দুর্বল হয়ে যাবে বলে ভেবেছিলো উমাইয়ারা।
কিন্তু তারা যেটা ভেবেছিলো তা আসলে হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে।
হুসেইনের মৃত্যুকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়ে শিয়া ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা হয় এবং দিনটি অর্থাৎ আশুরা প্রতিবছর পালন করা হয়।
শিয়া ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন এটি।
শিয়াদের শক্তিবৃদ্ধি ২১শতকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত আরো বাড়িয়েছে:
ইমাম হুসেইনের (রা.) হত্যাকাণ্ডের পর উমাইয়া খলিফা অর্থাৎ সুন্নি শাসকদের দ্বারা ইসলামী সম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এরপর ইউরোপীয় খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের সঙ্গে যুদ্ধ ও মধ্য এশিয়া থেকে আসা মঙ্গলদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। পরবর্তীতে ওসমানীয় তুর্কিদের মাধ্যমে ইসলামী সম্রাজ্যের বিস্তার লাভ করেছে।
তবে কারবালা ট্রাজেডির পর মোটাদাঁগে তিনটি বড় মাইলস্টোন শিয়া-সুন্নি বিভক্তি আরো বাড়াতে সহায়তা করেছে।
প্রথমত, ১৬শতকে সাফাভিদ রাজবংশের উত্থান
সাফাভিদরা তারা সুন্নি কেন্দ্রিক ইরানকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে শিয়াপ্রধান অঞ্চল এবং মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে রূপান্তর করে।
১৫শতকে পার্সিয়া (বর্তমানের ইরান) ছিলো সুন্নিপ্রধান জ্ঞানচর্চার সুতিকাগার। তবে আজেরি (আজারবাইজানি তুর্ক) গোত্রের বিজেতারা এখানে আসার পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
তারা এখানে সাফাভিদ রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত করে।
এই আজারিরাও মূলত তুর্কিদেরই একটি শাখা। তুরস্কের পূর্বাঞ্চল থেকেই তারা পার্সিয়াতে এসেছিলো।
সাফাভিদরা ইরানকে শিয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রাজনৈতিক প্রকল্প হাতে নেয়।
তারা পারস্যকে একত্রিত করে এবং পশ্চিমের সুন্নি উসমানীয় সম্রাজ্য থেকে এবং সুন্নি মুঘল মুসলিমদের থেকে আলাদা করে।
দ্বিতীয়ত, বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীদের পরাজয়
এ যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তির হাতে আরব ভূখণ্ড হারায় উসমানীরা। পরবর্তীতে দীর্ঘদিনের ধর্মীয় এবং জাতিগত বিবেচনায় আরবদের ভূখণ্ড ভাগ করে দেয়া হয়।
তৃতীয়ত বা সবশেষে, ১৯৮৯ সালের ইসলামী বিপ্লব

ইরানে ইসলামী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনী
দুপক্ষের দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সফল হওয়ার মধ্যমে। এই বিপ্লব সারাবিশ্বের শিয়াদের জন্য একটি চূড়ান্ত ব্রান্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়; যা কিনা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের রক্ষণশীল সুন্নিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের আগুনে ঘি ঢালে। এরপর দশকের পর দশক ধরে এই আগুন জ্বলছে।
ইসলামের রাজনীতিকিকরন এবং দুই পক্ষের মধ্যে রক্ষণশীলতার উত্থানে ২১শতকে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে মুসলিমদের এ দুই গ্রুপ। সুন্নি নেতা সাদ্দাম হোসেনের ইরাক যখন শিয়া শাসিত ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিলো তখনও যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার সুন্নি বন্ধুদের নিয়ে সাদ্দামের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান গৃহযুদ্ধের তেল ঢেলেছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব।

বিল্ডিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে এক যোদ্ধা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া সিরিয়ার কোবানে শহর দেখছেন; ২০১৫ সালের ছবি।
লেবানন, ইরাক, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন জায়গায় একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত।
বর্তমান সময় এই দ্বন্দ্বের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি সৌদি আরব এবং শিয়া ইরানের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা।
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের কতটা ধর্মীয়?
কয়েক শতাব্দী ধরে চলা এই বিভক্তির মধ্যেও মুসলিমদের এই দুটি পক্ষ শান্তিতে একসঙ্গে বসবাস করেছে। এ থেকেই ধারণা করা যায়, এই দ্বন্দ্ব অতটা ধর্মীয় কারণে নয়, বরং সম্পদ এবং ক্ষমতাই এর পেছনের মূল নিয়ামক।
বিংশ শতাব্দীতে দুই পক্ষের বিভক্তিতে আরো বেশ কিছু বিষয় রসদ যোগাচ্ছে। এরমধ্যে আছে, আরব-পার্সিয়ান জাতিভেদ, তেল রাজনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ।
বর্তমানে বড় পরিসরে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব নিয়ে যে দুই দেশ খেলছে, সেই সৌদি আরব এবং ইরান রক্ষণশীল একটি শাসনব্যবস্থা জারি রেখেছে।
এরা কেউই আসলে সারাবিশ্বের সকল সুন্নি অথবা সকল শিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে না।
হ্যাজলেটুন বলেন, যখন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে যায়, তখন পুরনো পরিচয়ে ফিরে যেতে হয়। আর শিয়া এবং সুন্নি হলো ১৪শ’ বছর পুরনো একটি পরিচয়।
সূত্র: হিস্টোরি ডট কম, এনপিআর ডট অর্গ, বিবিসি
আরো পড়ুন: