কখনো পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আত্মীয়, কখনো মন্ত্রীর বন্ধু। আবার কখনো বড় ব্যবসায়ী, ব্যাংক ঋণ নিয়ে দেয়া, এক জমি একাধিকবার বিক্রি, সমাজের প্রভাবশালীদের নিকট আত্মীয়, গ্যাস সংযোগ নিয়ে দেয়া ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ভালো জায়গায় পোস্টিং করে দেয়াসহ নানা বাটপারিতে দারুন পটু বাবা-ছেলে।
পুলিশে বদলী করিয়ে দেয়া, দীর্ঘদিন কারাবন্দিদের জামিন করিয়ে দেয়া, আবার কারাবন্দি ব্যক্তিদের স্ত্রী ও কন্যাদের কৌশলে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে এই চক্র। জামিন করিয়ে দেয়ার নামে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
শুধু তাই নয় বাবা-ছেলে মিলে একাধিক বিয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদও। প্রভাবশালী পরিবার দেখে ছেলেকে একের অধিক বিয়ে করিয়েও হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। আর প্রতারণার এসব টাকা দিয়েই বিলাসী জীবনযাপন কাটাতো তারা।
নারায়ণগঞ্জের গোলাম মোহাম্মদ কালু ও তার ছেলে গোলাম মোস্তফা আদরের প্রতারণা যেন সিনেমাকেও হার মানাবে। সম্প্রতি বাবা-ছেলের বাটপারি সামনে আসে। দু’জন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পরিবারকে জামিন করিয়ে দেয়া ও কৌশলে ব্ল্যাকমেইল করে।
এক এসপির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধু এসপিই নয়, তাদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পায়নি ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এমনকি খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষও। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’ প্রবাদটি যেন তাদের ক্ষেত্রে সত্য হয়েছে।
সম্প্রতি গোলাম মোহাম্মদ কালু ও তার ছেলে গোলাম মোস্তফা আদরকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে প্রায় একযুগ ধরে চালিয়ে আসা প্রতারণার কথা।
সবশেষ দু’জন সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পরিবারকে ফাঁদে ফেলে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া তারা। এর মধ্যে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মনজুকে জামিন করিয়ে দেয়ার কথা বলে তার স্ত্রী জাহানারা বেগম রেখার কাছ থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
স্বামীকে জামিন করিয়ে দেয়ার কথা বলে আরেকজন কারাবন্দি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের স্ত্রীর কাছ থেকে নেয় সাড়ে ৮ লাখ টাকা। এখানেই ক্ষ্যান্ত থাকেনি প্রতারকরা। পরে ওই কাউন্সিলরের স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করতেও নতুন ফাঁদ পাতে তারা।
প্রতারনার শিকার রেখা জানান, দীর্ঘদিন ধরে স্বামী কারাবন্দি থাকায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে গোলাম মোস্তফা তার নম্বরে ফোন করে। মনজুকে জামিন করাতে অন্যদের তিন মাস লাগলে তার লাগবে তিন দিন। তবে জামিন করানোর বিনিময়ে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে।
এরপর কয়েক দফায় সাড়ে ১১ লাখ টাকা দেয়ার পরও জামিনের ব্যবস্থা হয়নি। এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারেন প্রতারকদের ফাঁদে পড়েছেন। একটি মার্কেটে তার নামে থাকা দোকান বিক্রি করে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছিলেন তিনি। পরে ওই মার্কেটের দলিল গোলাম মোস্তফা ও তার বাবা গোলাম মোহাম্মদ কালুকে দেখানো হয়। তাদের কাছে দোকান কেনার একাধিক পার্টি রয়েছে বলে কৌশলে তার কাছ থেকে দোকানের দলিল হাতিয়ে নেয়া হয়।
একইভাবে তারা যোগাযোগ করেন কাউন্সিলর রাজীবের স্ত্রীর সঙ্গেও। এক পর্যায়ে রাজীবের স্ত্রীর সঙ্গে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে দেখা করেন। সেখানে তাদের ছবিও তুলে রাখেন আদর। পরে রাজীবকে মুক্ত করার জন্য তার কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নেন। কিছুদিন পর রাজীবের স্ত্রীও বুঝতে পারেন প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি। পরে তিনি (রাজীবের স্ত্রী) টাকা ফেরত চান। এতে আদর ক্ষিপ্ত হয়ে ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাটপার বাবা-ছেলে জানিয়েছে, গোলাম মোহাম্মদ কালুর বৈধ আয়ের সোর্স নেই। তবে ধানমন্ডিতে পরিবার নিয়ে আলিসান ফ্ল্যাটে থাকে। চলাফেরা করে টয়োটার প্রিমিও মডেলের গাড়িতে। তাদের অবৈধ অর্থের উৎস এক জমি একাধিকবার বিক্রি, সমাজের প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ করে দেয়ার ফাঁদ।
গ্যাসের সংযোগ নিয়ে দেয়ার কথা বলেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। আবার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ভালো জায়গায় পোস্টিং পাইয়ে দেয়ার কথা বলেও লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরেছে আদর ও তার বাবা।
জিলানি নামে এক ব্যবসায়ী জানান, একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে তাদের ১০ কোটি টাকা লোন করিয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি ও তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তাদের সঙ্গে ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে দেখা করে টাকাগুলো নেন আদর ও তারা বাবা। একইভাবে মৃণাল বাবু নামে এক কার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ৬ লাখ টাকা।
গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, ২০০৮ সালে অনেক মানুষকে প্রতারিত করার পর আত্মগোপনে যায় কালু। বাবার কাছে পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ছেলে। কিন্তু পরিশোধ করেনি এক টাকাও। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় ২০১২ সালে নিজেদের বাড়ি নিলামে ওঠে।
এরপর বাড়িছাড়া হয়ে দেনাদারদের টাকা পরিশোধ না করে পালিয়ে আসে ঢাকায়। বসবাস করতে থাকে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে। এরপর বাবা-ছেলে প্রতারণার পেশাই বেছে নেয়। প্রথম দিকে নিজেদের আত্মীয়দের সঙ্গে প্রতারণা করত। নিলামের বাড়ি ও জায়গা কিনে দেয়ার কথা বলে এক আত্মীয়র কাছ থেকে কালু ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
ছেলে আদর এখন পর্যন্ত চারটি বিয়ে করেছে। চারটি বিয়েই করেছে প্রতারণার ফাঁদ পেতে। এরইমধ্যে তিন স্ত্রী তাকে তালাক দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী আলিশা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ফেসবুকে পরিচয়ের মাধ্যমে বড় ব্যবসায়ী সেজে আলিশাকে বিয়ে করে আদর। প্রেমের টানে আলিশা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসে ২০১৮ সালে বিয়ে করেন আদরকে। কিছু দিন পর আদরের প্রতারণার বিষয় জানতে পেরে তাকে তালাক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যান আলিশা।
একপর্যায়ে রাজশাহীর এসপি বেলায়েতের সঙ্গে পরিচিত হন তারা। এরপর নিজের অসুস্থতার কথা বলে ৫ লাখ টাকা ধার নেয় আদর। এবং আগাম একটি চেক দেন। কিন্তু ওই টাকা তুলতে গিয়ে বেলায়েত জানতে পারেন আদরের একাউন্টে ২শ টাকা আছে। পরে আদরের সঙ্গে কথা বললে তিনি উল্টো বেলায়েতের নামে আদালতে মামলা করেন। প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে এসপি বেলায়েত ধানমন্ডি থানায় একটি জিডি করেন। এরইমধ্যে পিতা-পুত্রকে গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ডিসি মশিউর রহমান বলেন, ধূর্ত এই দুই প্রতারক সমাজের প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে তারা অনেক মানুষকে নিঃস্ব করেছে। জামিন করিয়ে দেয়া, পুলিশে বদলিও করে দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয় বলে স্বীকার করে। বিভিন্ন পরিচয়ে অভিনব প্রতারণায় জড়িত এই চক্র। এ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। দুই মামলায় তারা ২০ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।