ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আর নেই। সোমবার (৩১ আগস্ট) দিল্লির সেনা হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর।
প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারতীয় রাজনীতির একটি বিরাট অধ্যায়ের অবসান হল।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ১৮ এর খবরে বলা হয়েছে, বাথরুমে পড়ে ডান হাত অবশ হতে থাকায় দ্রুত প্রণব মুখার্জিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশনের আগে করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ রিপোর্ট আসে।
পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মাথায় জমাট বাঁধা রক্ত বের করা হয়। রাতেই তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হয়।
হাসপাতালে ভর্তির আগেও প্রণব মুখার্জি টুইট করে জানান, তিনি করোনা পজিটিভ।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সে বছর জুলাইয়ে আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়তে চাননি তিনি। বরং রাজনীতি থেকেই অবসর নেন।
সোমবার হাসপাতালে প্রণববাবুর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি ২০ মিনিট হাসপাতালে ছিলেন।
৫০ বছরেরও বেশি সময় সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা প্রণব মুখার্জিকে ২০১৯ সালে ভারত রত্ন সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৯৭ সালে তিনি সেরা সাংসদ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মান পান তিনি।
ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি
প্রণব মুখার্জি ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার রাজনৈতিক কর্মজীবন ছিলো ছয় দশকব্যাপী।
তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা। বিভিন্ন সময় ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।
২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখার্জি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতা।
১৯৬৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে প্রণব মুখার্জি ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হন।
এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান।
১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।
ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এই বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস পার্টিতে, এমনকি দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছে।
দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণ এবং শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
১৯৮৪ সালে, যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন।
প্রারম্ভিক জীবন
তার পুরো নাম ছিলো প্রণবকুমার মুখার্জি। প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে তার জন্ম। তার পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী।
তার বাবা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি দশ বছর কারাগারে ছিলেন।
পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য (১৯৫২-৬৪) হন।
প্রণব মুখার্জি সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা করেছেন। তখন কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।
ব্যক্তিগত জীবন
ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আরেকটি পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের জামাই। ১৯৫৭ সালে নড়াইল জেলার সদর উপজেলার ভদ্রবিলা গ্রামের শুভ্রা মুখার্জিকে বিয়ে করেন তিনি। অমরেন্দ্র ঘোষের কন্যা শুভ্রা ঘোষের জীবনের একটি অংশ কেটেছে এ গ্রামে। তাদের দুই পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে।
কর্মজীবন
প্রণব মুখার্জি তার কর্মজীবন শুরু করেন একজন কলেজশিক্ষক হিসেবে। পরে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি দেশের ডাক নামে একটি পত্রিকায় কাজ করতেন।
এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হন।
কর্মজীবনে প্রথম দিকে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত “বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল” এ ২ বছর শিক্ষকতা করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক জীবন
প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি হয়ে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন।
১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তার এই মন্ত্রীত্বকালে ড. মনমোহন সিং ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর।
ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হন প্রণব মুখার্জি। কিছু সময়ের জন্য তিনি কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল।
এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজের একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। এই সময় রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি।
পরবর্তীকালে পি. ভি. নরসিমা রাও তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত করলে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনের পুনরুজ্জীবন ঘটে।
রাওয়ের মন্ত্রিসভায় পরে তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবেও যোগ দেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন।
আরো পড়ুন:
হিমঘরে সি আর দত্ত, শেষকৃত্য কাল
প্রণব মুখার্জি জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি হন। ২০০৪ সালে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায়, প্রণব মুখার্জিকে লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০১২
এনডিএ প্রার্থী লোকসভার সাবেক স্পিকার মেঘালয়ের ভূমিপুত্র পিএন সাংমাকে ৭১ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে ইউপিএ প্রার্থী প্রণব মুখার্জি নির্বাচিত হন।
২৫ জুলাই ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।