‘শুধু দেখ, তাকে নিয়ে কিছু লিখতে যেও না সে বর্ণনাতীত’ উক্তিটি ফুটবলার মেসিকে সবচেয়ে বেশি কাছ থেকে দেখা বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলার। ফুটবলে মেসি যা করেছেন তা আসলেই বর্ণনাতীত। মেসির গুণকীর্তন করতে বসলে দিস্তার পর দিস্তা কাগজই ফুরোবে তাতেও তার মহিমা ফুটিয়ে তোলা যাবে না। বর্তমান সময়ে আরেকবার শিরোনামে লিওনেল মেসি। বার্সেলোনা ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। শেষতক মেসি বার্সায় থাকবেন নাকি অন্য কোনো ক্লাবে যাবেন সেটা সময়ই বলে দেবে আসুন আমরা মেসির অনন্য সেরা দশটি কীর্তির কথা জেনে নেই।
এক মৌসুমের সব প্রতিযোগিতায় গোল
রেকর্ডটা ২০১১ সালেই হতো পারতো। সেবার লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা দেল রে, উয়েফা সুপার কাপ, স্প্যানিশ সুপার কাপ ও ক্লাব বিশ্বকাপে গোল করেন মেসি। প্রথম কোনো ফুটবলার হিসেবে এক মৌসুমে ৬টি আসরে গোল করার অনন্য রেকর্ড করেন তিনি। সাতে সাত করতে পারেননি। সেবার কোপা আমেরিকায় চার ম্যাচের একটিতেও গোল পাননি মেসি। ২০১৫ সালে এসে সেই ভুল আর করেননি। বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র ফুটবলার হিসেবে মৌসুমের সবকটি টুর্নামেন্টে গোলের দেখা পেয়ে যান বার্সা সুপারস্টার। কে জানে, মেসির এই রেকর্ড হয়তো আজীবনই টিকে থাকবে!
এল ক্লাসিকোর রাজা
ফুটবল বিশ্বে সবচেয়ে জমজমাট দ্বৈরথের নাম এল ক্লাসিকো। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার ঐতিহ্যগত ও ঐতিহাসিক এই লড়াইয়ের অবিসংবাদিত রাজার নাম লিওনেল মেসি। এল ক্লাসিকোতে ২৬ গোল করেছেন তিনি। ভেঙেছেন প্রায় আধা শতাব্দী ধরে টিকে থাকা স্বদেশি কিংবদন্তি আলফ্রেডো ডি স্টেফানোর ১৮ গোল করার রেকর্ড। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরও রয়েছে ১৮টি গোল। মজার ব্যপার হচ্ছে, রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার পর এল ক্লাসিকোতে আর একটিও গোল করতে পারেননি মেসি!
সুপার সাবস্টিটিউট
মেসি আজ প্রথম একাদশে নেই। ম্যাচের আগে এই তথ্যটাই প্রতিপক্ষের মনোবল কয়েকগুণ চাঙা করতে যথেষ্ট। প্রথম একাদশে না থাকা মেসি কিন্তু অনেক ভয়ঙ্কর। বদলী ফুটবলার হিসেবে নেমে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ৩৪টি গোল করেছেন মেসি, এর ২২টিই লা লিগায়। তবে যে কোনো একক লিগে বদলি ফুটবলার হিসেবে সবচেয়ে গোলের রেকর্ডটি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নরওয়েজিয়ান উইঙ্গার ‘বেবি ফেস অ্যাসাসিয়ান’খ্যাত ওলে গানার সোলস্কারের। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বদলি ফুটবলার হিসেবে তিনি করেন ২৮ গোল।
এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল
মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথটা তখন জমজমাট। আগের মৌসুমে লিগে দুজনেই করেন ৫৩টি করে গোল। ২০১১-১২ মৌসুমে রোনালদোকে যোজন ব্যবধানে পেছনে ফেলে লিগে গোলসংখ্যাটাকে ৭৩ এ নিয়ে যান মেসি। সেবার সব প্রতিযোগিতা মিলে মেসি করেন ৯১ গোল! রীতিমত অপ্রতিরোধ্য মেসি ভেঙে দিয়েছিলেন গার্ড মুলারের এক বছরে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড (৮৫)। সেবার ৯১ গোল করতে মেসির লেগেছিল ৬৯ ম্যাচ। ইএসপিএন এর তথ্যমতে, প্রতি ৬৬ মিনিটে একটি গোল করেন মেসি। বার্সার হয়ে ৬০ ম্যাচে করেন ৭৯ গোল, জাতীয় দলের হয়ে ৯ ম্যাচে করেন ১২ গোল আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১২ ম্যাচে করেন ১৩ গোল। এক ম্যাচে সবোর্চ্চ ৫ গোলসহ হ্যাটট্রিক করেছিলেন ৯ ম্যাচে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সবচেয়ে বেশি হ্যাটট্রিক
ফুটবল বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার হলো ইউরোপের সেরা দলগুলোর লড়াই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে বেশি ৮টি হ্যাটট্রিকের মালিক লিওনেল মেসি। এই প্রতিযোগিতায় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হ্যাটট্রিকও ৮টি। লা লিগায় মেসির হ্যাটট্রিকের সংখ্যা ৩৫টি। স্প্যানিশ লিগে মেসির চেয়ে হ্যাটট্রিক করেননি আর কোনো ফুটবলার। সব মিলিয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলারের হ্যাটট্রিক সংখ্যা ৫৩টি।
সবচেয়ে কম বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেঞ্চুরি
রাশিয়ান ক্লাব শাখতার দোনেৎস্কের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মেসির অভিষেক হয় ২০০৪ সালে। ১১ বছর পর রোমে এএস রোমার বিপক্ষে লিগে শততম ম্যাচে মাঠে নামেন বার্সেলোনার ওয়ান্ডার বয়। তার বয়স তখন মাত্র ২৮ বছর ৮৪ দিন। এর চেয়ে কম বয়সে চ্যাম্পিয়নস লিগে ম্যাচের সেঞ্চুরি করতে পারেননি আর কেউ। সেদিন মেসি যার রেকর্ড ভেঙেছিলেন তিনি হলেন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক ফরোয়ার্ড রাউণ গঞ্জালেস। ২৮ বছর ১৫৫ দিনে রাউল চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শততম ম্যাচ খেলেন।
টানা চারবার ব্যালন ডি অর
জোহান ক্রুইফ ১৯৭৪ সালে তৃতীয়বারের মতো যখন ব্যালন ডি’ অর জেতেন সাংবাদিকরা তখন বলছিলেন ক্রুইফ নাকি ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন! ক্রুইফের পর মিশেল প্লাতিনি ও মার্কো ভ্যান বাস্তেনও তিনবার করে এই পুরস্কার জেতেন।
সবাইতে অবাক করে দিয়ে ২০১২ সালে টানা চতুর্থবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতেন লিওনেল মেসি। সব মিলিয়ে ৬বার বিশ্বসেরা ফুটবলারের এই খেতাব জিতেছেন তিনি। ২০১২ সালে টানা চতুর্থবার মেসি যখন ব্যালন ডি’অর গ্রহণ করেন তখন তার বয়স মাত্র ২৫ বছর। আচ্ছা বলুন তো, এতো কম বয়সে ৪ বার আর কেউ ব্যালন ডি’অর জিততে পারবে?
আরো পড়ুন: মেসি-বার্সার সুখের সংসারে কুচ্ছিত বিচ্ছেদ
টানা ২১ ম্যাচে গোল
সেদিন বাধ সাধলো ইনজুরি। অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ম্যাচের ৬৭ মিনিটে ডান পায়ে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে মাঠ থেকে বের হয়ে যাওয়ার কারণে থেমে যায় মেসির টানা ২১ ম্যাচে ৩৩ গোলের বিশ্বরেকর্ড। ২০১১-১২ মৌসুমে রিয়াল মায়োর্কার বিপক্ষে ম্যাচে দুই গোল করেন মেসি সেই গোলযাত্রা অব্যাহত থাকে পরের মৌসুম পর্যন্ত। ২১ ম্যাচের সেই যাত্রায় মেসি ভেঙে দেন জার্ড মুলারের টানা ১৬ ম্যাচে গোল করার রেকর্ড। মেসির রেকর্ড ভাঙতে হলে টানা ২২ ম্যাচে গোল করতে হবে! নিশ্চিতে বাজি ধরতে পারেন এই রেকর্ড কোনোদিনই ভাঙবে না!
ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট
ডেড বলে মেসির চেয়ে ভয়ঙ্কর ফুটবলার খুব কমই আছেন। ২০০৮ সালের ৪ অক্টোবর অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে ফ্রি কিকে গোল করেন তিনি। এরপর টানা ১০ মৌসুমেই ফ্রি কিকে গোল পেয়েছেন এই অতিমানব। ফ্রি-কিক থেকে ৫২ গোল করেছেন তিনি। টানা ১০ মৌসুমের প্রতিটিতে ৪০ এর বেশি গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় মেসি।
টিনএজ, ২০ এবং ৩০ এ বিশ্বকাপে গোল করা একমাত্র ফুটবলার
২০০৬ সালের বিশ্বকাপের কথা মনে আছে। সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টিনিগ্রোর বিপক্ষে ম্যাচে গোল করে ফুটবল বিশ্বে নিজের আগমনের বার্তা দিয়ে রাখেন লিওনেল মেসি। তখন তার বয়স মাত্র ১৯। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিশ্বকাপেও জাতীয় দলের হয়ে গোল করেছেন তিনি।