লিবিয়ার বিদ্রোহী সেনা অধিনায়ক খলিফা হাফতারের হয়ে যুদ্ধের জন্য তিন শতাধিক সিরিয় যোদ্ধাকে সেদেশে পাঠিয়েছে রাশিয়া। এদের মধ্যে অন্তত আট জন এমন যোদ্ধা রয়েছে যারা এক সময় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের হয়ে লড়াই করেছে।
তুরস্কের সেনা সমর্থনে ত্রিপলিভিত্তিক আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) সম্প্রতি সময়ে বড় ধরনের সামরিক সফলতা পাওয়ার পর এ ধরণের পদক্ষেপ বিদ্রোহী হাফতারের সমর্থক রাশিয়ার পক্ষ থেকে।
তুরস্কের সরকারি বর্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির বরাতে মিডল ইস্ট মনিটরের খবরে বলা হয়েছে, এই সকল যোদ্ধাকে সিরিয়ার দেইর আল জোর এলাকা থেকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে।
এই যোদ্ধারা ফাতেমিউন এবং জায়নাবিউন ব্রিগেডের সদস্য। এমনকি তারা ইরানের আল কুদস ফোর্সের হয়েও সিরিয়ায় যুদ্ধ করেছে। আবার কখনো কখনো আসাদ সরকারের সেনাবাহিনীর হয়েও লড়াই করেছে।
এছাড়া আইএসের যে সকল যোদ্ধাকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে তারা মূলত দাবলান শহরের বাসিন্দা। আসাদ সরকারের সঙ্গে এক চুক্তির ভিত্তিতে তারা পরবর্তীতে আল কুদস ফোর্সে যোগ দেয়।
রাশিয়া আগেও খলিফা হাফতারের সমর্থনে কয়েক হাজার যোদ্ধা লিবিয়াতে পাঠিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী এসব যোদ্ধা মাসে ১ হাজার মার্কিন ডলার পেয়ে থাকে। এছাড়া তিন মাস পর পর অতিরিক্ত দেড় হাজার ডলার দেয়া হয় তাদের। কখনো কখনো এর পরিমাণ বাড়ানো হয়।
লিবিয়ায় পাঠানোর আগে গত এপ্রিলে সিরিয়ার এই ৩০০ যোদ্ধাকে ট্রেনিং দেয় রাশিয়া। দেশটির হোমস শহরের কাছাকঠি একটি ক্যাম্পে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। গত ২৬ জুন লিবিয়ার জিএনএ সমর্থিত সেনাবাহিনী ঘোষণা করে, সিরতে বিমানবন্দরে অন্তত ১১টি রাশিয়ান বিমানে করে বিদেশি যোদ্ধা এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছে।
জেনারেল হাফতারের হয়ে আগে থেকেই আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে নিয়ে আসা যোদ্ধারা লড়াই করছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে রাজধানী ত্রিপোলি দখলের জন্য হামলা চালিয়ে আসছিলো হাফতারের বাহিনী। কিন্তু তুরস্কের সমর্থনে ত্রিপলির সীমান্ত থেকে তাদের হটিয়ে দিয়েছে সরকারি সেনারা। এছাড়া সম্প্রতি পাল্টা আক্রমণে বেশ কিছু কৌশলগত এলাকা এবং বিমানবন্দরসহ পশ্চিম লিবিয়ার অধিকাংশ এলাকা দখলে নিয়েছে তারা।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপট:
২০১১ সালে ন্যাটো সমর্থিত বিদ্রোহীরা লিবিয়ার ৪১ বছরের স্বৈরশাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করে। এরপর থেকেই দেশটিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
২০১৪ সালে ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের সঙ্গে বড় ধরণের সংঘাত শুরু হয় পূর্বাঞ্চলের বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়া মেজর জেনারেলে খলিফা হাফতার। তবে ফায়াজ আল-সারাজের জিএনএ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িত দুই পক্ষেরই আন্তর্জাতিক সমর্থন আছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক, ইতালি এবং কাতার। অপরদিকে জেনারেল হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (এলএনএ) সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ফ্রান্স। যদিও ফরাসি সরকার জেনারেল হাফতারকে সমর্থন দেয়ার কথা বরাবর অস্বীকার করে আসছে।
জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, লিবিয়াতে কোনো সৈন্য মোতায়েন এবং অস্ত্র পাঠানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিবদমান দুই পক্ষই সেটি মানছে না।
লিবিয়া যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে তুরস্ক:
গত বছরের এপ্রিল থেকে ত্রিপলি দখলের জন্য অভিযান চালিয়ে আসছে এলএনএ। হাফতারের লাগাতার আক্রমণে কোণঠাসা জিএনএ সরকারের সঙ্গে ২০১৯ সালে একটি সামরিক চুক্তি করে তুরস্ক। ওই বছর জানুয়ারি মাসেই লিবিয়ায় সেনা মোতায়েন করে আঙ্কারা।
এরপরই আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকে লিবিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপট। গত বছরের এপ্রিল থেকে ত্রিপোলি দখলের মাধ্যমে পুরো লিবিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে আসছিলো খলিফা হাফতারের বাহিনী। কিন্তু তুরস্কের সেনা ও অস্ত্র সহায়তায় সেই আশা পূরণ হয়নি হাফতারের। তুর্কি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ড্রোন হাফতারের সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। গতমাসে (জুনে) জিএনএ বাহিনী অবশেষে ত্রিপলির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। জেনারেল হাফতার শহরের উপকণ্ঠ থেকে তার সেনাদের প্রত্যাহার করে নেয়।
মে মাসে জাতিসংঘের একটি রিপোর্ট ফাঁস হয়। যাতে বলা হয়, ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন পরিচালিত রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ থেকে কয়েক’শ সৈন্য লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের সমর্থনে যুদ্ধ করছে। বলা হয় ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন প্রেসিডেন্ট পুতিনের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
তবে সম্প্রতি ত্রিপোলি থেকে থেকে ব্যর্থ হয়ে হাফতারের পিছু হটার মধ্যে খবর প্রকাশিত হয় যে, ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে সৈন্যরা লিবিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে পশ্চিম লিবিয়ার অধিকাংশ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সরকারি বাহিনী। এখন দেশটির গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শহর সিরতে পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে তারা। এটি সাবেক স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির জন্মভূমি। এদিকে সিরতে রক্ষার জন্য বিপুল পরিমাণ সেনা মোতায়েন করেছে এলনএন।