দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের পাহাড়, নদী ও সাগরঘেরা একটি দেশ বুলগেরিয়া। দেশটি বলকান উপদ্বীপের পূর্ব পার্শ্বে ইউরোপ ও এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত। এর আয়তন প্রায় ৪২,৮৫৫ বর্গমাইল। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বুলগেরিয়া অন্যতম প্রাচীন একটি দেশ যেখানে সেই প্রস্তর যুগের সময় থেকেই মানব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। পূর্বে কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে গ্রিস ও তুরস্ক অবস্থিত। এর পশ্চিমে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো এবং ম্যাসিডোনিয়া ও রোমানিয়া রয়েছে।
বুলগেরিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ। এর মধ্যে শতকরা ৭৮ ভাগ জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান এবং শতকরা ১৮ ভাগ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। অর্থাৎ এখানে ৬ লাখের বেশি মুসলমান রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ধর্মের এবং কোন ধর্মে বিশ্বাস করে না এমন জনগোষ্ঠী রয়েছে সে দেশে। তবে সাংবিধানিকভাবে বুলগেরিয়া ধর্ম-নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র।
মুসলমানরা এখানে সংখ্যালঘু হলেও দিন দিন মুসলিম জনসংখ্যার হার বাড়ছে। মুসলিমদের বেশির ভাগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাস করে। তুরস্কের উসমানীয় শাসকরা পাঁচ শ বছরেরও বেশি সময় বুলগেরিয়া শাসন করেন। বুলগেরিয়ার রাজধানী ও বৃহত্তম শহর সোফিয়া।
বুলগেরিয়ায় ইসলামের আগমন ও মুসলিম ঐতিহ্য:
জানা যায়, নবম শতকে বরিস অব বুলগেরিয়াকে লেখা পোপ নিকোলাসের এক চিঠিতে মুসলমানের বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে তার আগেই বুলগেরিয়ায় পৌঁছেছিল ইসলাম প্রচারকদের দল বলে ধারণা করা হয়।
পরে তুরস্কের উসমানীয় খলিফা সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহের হাতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হলে বুলগেরিয়ায় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়। ১৩৬২ সালে সুলতান প্রথম মুরাদ বাইজান্টাইন সম্রাটের কাছ থেকে বুলগেরিয়ার আড্রিয়ানোপল জয় করেন। আর ১৩৮২ সালে রাজধানী সোফিয়া উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় পুরো বুলগেরিয়া উসমানীয়দের শাসনাধীন হয় অর্থাৎ মুসলিম শাসনের আওতায় আসে। আর ১৩৯৬ সালে ‘ব্যাটল অব নিকোপলিস’-এর মাধ্যমে ভিডিনের পতন হয়। এররও প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ১৪৫৩ সালে সর্বশেষ বুলগেরীয় ভূখণ্ড মুসলিমদের শাসনাধীন হয়।
বিভিন্ন ঘটনার ও ইতিহাসের পরিক্রমায় রুশ-তুর্কি যুদ্ধ এবং ১৮৭৮ সালের বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে বুলগেরিয়ায় মুসলিম শাসনের অবসানের সূচনা হয়। ১৯৮৪ সালে বুলগেরিয়ায় কমিউনিস্টদের উত্থান হলে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। মুসলিমদের বুলগেরীয় নাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়। ১৯৮৯ সালে প্রায় সাড়ে তিন লাখ তুর্কি মুসলিম বুলগেরিয়া ত্যাগে বাধ্য হয়। কমিউনিস্ট শাসন আমলে মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হতে থাকে মুসলমানেরা। তবে জিবকভ শাসনব্যবস্থার অবসানের পর মুসলিমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভ করে। তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া মসজিদ-মাদরাসা পুনরায় খুলে দেওয়া হয়।
মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা:
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মুসলমানরা বুলগেরিয়াতে মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে। নিজেদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ফিরে পেয়েছে। বিশেষত বুলগেরিয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার পর এবং ২০০৭ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার পর থেকে মুসলমানদের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে।
ইতিহাসের পরম্পরায় যুদ্ধ-বিগ্রহ ও লড়াইয়ের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা কমে আসে। মুসলমানরা সুন্নি সম্প্রদায়ের। তবে কিছু শিয়া সম্প্রদায়েরও রয়েছে। ২০১৭ সালে পরিচালিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে বলা হয়, ১৫% বুলগেরিয়ান নাগরিক মুসলিম। তবে সর্বশেষ আরও একটি জরিপে দেশটিতে বর্তনাম মুসলিম নাগরিকের সংখ্যা ১৮% দেখানো হয়েছে। এখানে অধিকাংশ মুসলমান যুগোস্লাভিয়া, গ্রিসের সীমান্তবর্তী অঞ্চল, ইস্ট ডুরপাস, কাতরলোয়া, লুডুগুরিয়া ও স্লানিক এলাকায় বসবাস করে। বুলগেরিয়ান মুসলমানদের ৬০% তুর্কি। বাকি ২৫% স্থানীয় নাগরিক।
মসজিদ ও বিভিন্ন ইসলামি সংস্থার সংখ্যা:
এক সময় বুলগেরিয়াতে মসজিদ ছিল ১২শ’র বেশি। তবে বর্তমানে মসজিদের সংখ্যা নিতান্ত কম। সব মিলিয়ে ১০ টির মতো হবে। ১৩৯৪ সালে নির্মিত বুলগেরিয়ায় উসমানী সাম্রাজ্যের সবচেয়ে পুরোনো ঐতিহাসিক ইস্কি মসজিদ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে তুরস্কের উদ্যোগে নতুন করে চালু করা হয়েছে।
বুলগেরিয়ার মুসলমানদের সার্বিক অবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য কয়েকটি ইসলামি সংস্থা রয়েছে। ১. দারুল ইফতা, ২. সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল, ৩. চ্যারিটি ফর দ্যা ডেপলপমেন্ট অব কালচার। এছাড়াও কোরআন শেখার বিভিন্ন মাদরাসা ও শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
সুপ্রিম ইসলামিক কাউন্সিল ইসলামী শিক্ষার যাবতীয় দিক দেখভাল করে। বিশাল পরিকল্পনা করে কর্তৃপক্ষ একটি ইসলামিক একাডেমিও নির্মাণ করছে। যেখান থেকে বৃহৎ পরিসরে ইসলামী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এছাড়াও বুলগেরিয়ার দারুল ইফতা মুসলমানদের জরুরি বিধান-হুকুম প্রণয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন দীক্ষামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে আশার কথা ৫শ বছর শাসন করা মুসলমানরা তাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আবারও ফিরে পাচ্ছে ধীরে ধীরে।