দেশের চলচ্চিত্রের উত্থান পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিএফডিসি বা বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন। তবে এটি সাধারণ মানুষের কাছে এফডিসি নামেই বেশি পরিচিত।
ঢাকাই সিনেমার এই সূতিকাগার নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই সাধারণ মানুষের। কি আছে এখানে সেটা দেখার জন্য বিএফডিসির গেটে সিনেমা ভক্তদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আজ আমরা বিএফডিসি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো।
পাকিস্তানি শাসনামলে ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের একান্ত আগ্রহ ও উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি এবং স্টুডিও চালু হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রথম নির্বাহী পরিচালকও হন তিনি।
১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মস নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ-এর নির্মাণ কাজ। সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন আবদুল জব্বার খান। সেই সময়ই কো-অপারেটিভ ফিল্ম মেকার্সের ব্যানারে আরও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন সারোয়ার হোসেন। এটির নাম ছিল ‘আপ্যায়ন’।
এসব কর্মকাণ্ড চলমান থাকা অবস্থায় ১৯৫৫ সালের জুনে তেজগাঁওয়ে সরকারি ফিল্ম স্টুডিও চালু হয়। আর ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পায় বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’।
এরপর ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ইপিএফডিসিতে ১৯৫৯ সাল থেকে নিয়মিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে থাকে।
তখন ইপিএফডিসি সঙ্গে সঙ্গে ছাড়াও বারী স্টুডিও, পপুলার স্টুডিও ও বেঙ্গল স্টুডিও দেশের চলচ্চিত্রের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে এই ইপিএফডিসি নামকরণ করা হয় বিএফডিসি।
বিএফডিসির ভেতরে যা আছে:
রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘেঁষে তেজগাঁও কারওয়ান বাজার রোডের পাশেই অবস্থান বিএফডিসির। কেপিআই এলাকা হওয়ায় কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় এর প্রাঙ্গণে। প্রথম আসা দর্শনার্থীর কাছে এ এক জাদুর জগত। বিভিন্ন জায়গাতে চলছে শুটিং। পাশের টিনসেডগুলো আসলে শুটিং ইউনিটের স্টোররুম।
এফডিসির ভেতরে দেখা মিলবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ট্যাচুসহ নানা ম্যুরাল। এফডিসির স্টাডি রুমগুলোতে চলে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী সমিতির কার্যকলাপ। রয়েছে একটি ক্যান্টিন। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ছবির জন্য তৈরি করা হয় কৃত্রিম সব ঘরবাড়ি, স্কুল কলেজ, মার্কেট, হাসপাতাল, জেলখানাসহ ছবির প্রয়োজনের সকল সেট। প্রথম এসব বিষয় দেখে অনেকেই পড়ে যেতে পারেন ধন্ধে। কারণ পর্দায় এতদিন যেসব দুর্ধর্ষ চিত্রগুলো দেখেছেন তা যে এভাবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয় না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
বিএফডিসিতে রয়েছে মোট ৯টি ফ্লোর। প্রতিটি ফ্লোরেই রয়েছে মেকআপ রুমসহ শুটিংয়ের সকল সুবিধা। শুটিং উপযোগী এই ফ্লোরগুলো ভাড়া নিয়ে নিয়মিতই চলে শুটিং।
ফ্লোরের বাইরে আছে সুইমিং পুল, সরু রাস্তা, ঝর্ণাস্পট। এ স্থানগুলো দেখলে অনেকেই মিলিয়ে নিতে পারবেন পর্দায় বিভিন্ন সময়ে দেখা দৃশ্যগুলোর সঙ্গে।
বিএফডিসিতে আরও রয়েছে ডাবিং বিল্ডিং, মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স। রয়েছে বাগান ও সরু রাস্তা। শুটিংয়ের প্রয়োজনেই এসব নির্মাণ করা হয়েছে। শুটিং থাকলে বেশ কর্মমূখর হয়ে উঠে ফ্লোরগুলোসহ পুরো বিএফডিসি। সুইমিংপুলে যোগ হয় নতুন পানি। ঝর্ণা পায় নতুন চেহারা।
শুরুর দিকের ছবিগুলোর প্রায় পুরো শুটিং এই বিএফডিসির ভেতরেই শেষ করা হতো। কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে সময়ের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে শুটিং করা হয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে। সঙ্গে স্যাটেলাইট, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন কারণে দেশে কমেছে সিনেমা হলের সংখ্যা, সঙ্গে কমেছে দেশের সিনেমার দর্শক। এরই ধারাবাহিকতায় জৌলুশ হারিয়ে অনেকটাই জীর্ণদশা এক সময়ের কোলাহল মুখর ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাটের বিএফডিসি।